বাংলা একাডেমিই ছিল তাঁর প্রথম ও শেষ প্রেম
অনুপম নিউজ টোয়েন্টিফোর ডট কম প্রকাশিত হয়েছে : ২০ এপ্রিল ২০২১, ৭:১৮:২১ অপরাহ্ন
:: সরকার আমিন ::
গতকাল ১৪ এপ্রিল, বাংলা নববর্ষের দিন আসর নামাজের পর মানিকগঞ্জে মায়ের কবরের পাশে সমাহিত হয়েছেন শামসুজ্জামান খান! ৮১ বছরের কর্মকোলাহলময় একটা সৃষ্টিশীল জীবনের অবসান হলো। বাংলা সন তারিখ নিয়ে তাঁর বেশ গবেষণা ছিল, ছিল ফোকলোরিক কৌতূহল। বাংলা সন শুরুর দিনটিতেই তাঁকে চলে যেতে হলো! তিনি বাংলা একাডেমিতে দীর্ঘদিন কাজ করেছেন পরিচালক, মহাপরিচালক এবং সভাপতি হিসেবে। বাংলা একাডেমিই ছিল তার প্রথম ও শেষ প্রেম। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁকে নিয়ে ফেইসবুকে সম্প্রচারিত আমার প্রতিক্রিয়াগুচ্ছ এখানে উল্লেখ করতে চাই। প্রতিক্রিয়াগুলোর মধ্যে আমি তাঁকে যেভাবে দেখেছি, তা সামান্য বর্ণিত হয়েছে বলে মনে হয়।
১.
সপ্তাহ খানেক আগে বুলবুলকে ফোন দিলাম। বুলবুল বলল, স্যারের মুখে অক্সিজেন। অবস্থা ভালো না। ফোন রেখে দেবো—এমন সময় বুলবুল বলল, স্যার, বুঝতে পেরেছেন এটা আপনার ফোন। কথা বলতে চাইতেছে। বুলবুল ফোনটা মুখের কাছে ধরল। স্যার কিছু অস্পষ্ট কথা বললেন। কিছু শব্দ বুঝতে পারলাম, “আমিন”/ “বাংলা একাডেমি” “ভালো থেকো”…..!
তখনও আশা করতে ছিলাম, তিনি ফিরে আসবেন! কারণ ভয়াবহ হার্ট সমস্যার পরও ফিরে এসেছিলেন। বাম হাত দিয়ে ডান হাতকে তুলে আঙুল চেপে তাকে লিখতে হতো, তবু তিনি লিখতেন। কৌশলী প্রশাসক ছিলেন— বুঝতেন কোন মানুষের সাথে কেমন ব্যবহার করতে হবে। প্রায় সময়েই বলতেন, বসো মিয়া শেখো কিভাবে প্রশাসন চালাতে হয়। ধান্দা নিয়ে আসা অতিথি চলে গেলে জিজ্ঞাসা করতেন কেমন সামাল দিলাম মিয়া? বলতাম, স্যার আপনার চাকুরি জাতিসংঘে হইলে বেশ হইতো! “নিন্দা করলা না প্রশংসা করলা” বলেই মৃদু হাসতেন! মৃদু হাসিটি তার ট্রেড মার্ক ছিল।
২.
শামসুজ্জামান খান আমাকে আর প্রয়াত ড. অনু হোসেনকে অনেক স্পেস দিয়েছিলেন। আমি ঠাস করে তাঁর মুখের উপর অপ্রীতিকর সত্যও বলে বসতে পারতাম। তিনি রাগ করার বদলে হাসতেন আর একটা ডায়লগ দিতেন-“ওই মিয়া থামো”! একদিন বলেছিলাম, স্যার আপনি একটা “লিপ্সুক!” একটু থমকে গেলেন। বললাম, “জীবন-লিপ্সুক”! হা হা করে হাসলেন। আজ বলছি সত্যি একজন জীবনলিপ্সুক মানুষ আজ গত হয়ে গেলেন। জীবনকে উপভোগ করে গেছেন। সফল জীবন ছিল তাঁর।
৩.
তাঁর কিছু ছেলেমানুষি ছিল। বড়মানুষের যা থাকে। একদিন আমাকে জরুরি তলব করলেন। তাঁর অফিস কক্ষে গিয়ে দেখি রেগে আগুন— আমাদের এক সহকর্মীর ওপর। সহকর্মীটি আবার ফোকলোর করে। বললেন, ওর তো চাকুরি যাওয়া উচিত। আমি চুপচাপ রাগ প্রকাশক কথাবার্তা শুনলাম। “তুমি কিছু কউনা কেন মিয়া? তুমিও অরে সমর্থন করো নাকি?”— আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন। বললাম, স্যার কফি খাব। কফির অর্ডার দিলেন। শান্ত হলেন। বললাম, স্যার একটা প্রশ্ন করতে পারি?
বলো।
মানুষ মরণশীল কি?
মুচকি হেসে বললেন, দার্শনিকতা শুরু করলা!
বললাম, স্যার আপনি শত বছর বাঁচুন দোয়া করি। কিন্তু যদি মারা যান আপনাকে নিয়ে শোকসভায় সবচেয়ে ভালো ভাষণটি কে দেবে জানেন? স্যার হতভম্ব। কে?
বললাম, …. অমুক। যার উপর আপনি ক্ষেপে আছেন। শামসুজ্জামান খান চুপ মেরে গেলেন। পরদিন অবাক হয়ে দেখলাম— তিনি ওই কর্মকর্তাটিকে নিয়ে কফি খাচ্ছেন। শেষদিন তক তিনি কর্মকর্তাটিকে অশেষ স্নেহ দিয়ে গেছেন। এই গল্পটি একাডেমির আমার ঘনিষ্ট কয়েকজন জানেন। তিনি যেমন ছিলেন প্রাণবান, প্রজ্ঞাবান তেমনি ছিলেন শিশুর মতো সরল ও অভিমানী কোনো কোনো ক্ষেত্রে।
৪.
শামসুজ্জামান খান উপমহাদেশের ইতিহাস নিয়ে খুবই অনুসন্ধানশীল ছিলেন। আমাদের সাথে কথা হলেই মধ্যযুগের মুঘল রাজত্বের সেকুলার দিকগুলো নিয়ে বলতেন। আসলে তিনি একটি সেকুলার রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয়তা তীব্রভাবে অনুভব করতে পেরেছিলেন। খুব কষ্ট পেতেন সাম্প্রতিক সময়ের রাজনৈতিক চরিত্রহীনতা দেখে।
৫.
একটা জিনিস বলতেই হয় তিনি কবিতা বুঝতেন। কবি ও কবিতার প্রতি তার প্রবল আগ্রহ ছিল। যে কারণে উত্তরাধিকার পত্রিকাটিতে নতুন সময়ের কবিতা আমরা গুরুত্বের সাথে প্রকাশ করতে পারতাম। নতুন সময়ের কবি ও কবিতার তিনি পৃষ্ঠপোষক হতে চেয়েছিলেন। সে জন্য উত্তরাধিকার পত্রিকায় আমরা একটি বিশেষ আয়োজন করতে পেরেছিলাম। সেটি পরে বই হিসেবে প্রকাশিত হয়। এই উদ্যোগ নিয়ে ব্যাপক বিতর্ক হয়। এই বিতর্ক প্রমাণ করে কাজটি প্রয়োজনীয় ছিল।
৬.
শামসুজ্জামান খান ছিলেন মৃদুভাষী মানুষ। খুবই বুদ্ধিমান। তাঁর ভারসাম্যবোধ ছিল। ছিলেন উদার মানবতাবাদী। বাংলাদেশে আধুনিক ফর্মে ফোকলোর চর্চায় তিনি ছিলেন অগ্রপথিক। এই ফিল্ডে তার অবদান অপরিসীম।
ড. সরকার আমিন, উপ-পরিচালক বাংলা একাডেমি