টেক্সাসে ৬ বাংলাদেশির মৃত্যু: স্থানীয় আমেরিকানসহ অন্তিমযাত্রায় হাজার গাড়ি, প্রকৃতিও যেন নিরবে কিছু বলতে চায়..
অনুপম নিউজ টোয়েন্টিফোর ডট কম প্রকাশিত হয়েছে : ১০ এপ্রিল ২০২১, ৯:৫৭:২৮ অপরাহ্ন
অনুপম প্রতিবেদন: মৃত্যু অনিবার্য। মৃতের সামনে মানুষ নিরব হয়ে যায়। কোনো কোনো মৃত্যু জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সব মানুষকে স্পর্শ করে খুব। ফক্স ফোর টিভি চ্যানেলকে টেক্সাসের অ্যালান সিটিতে পারিবারিক হত্যা ও আত্মহত্যায় মারা যাওয়া ৬ বাংলাদেশির বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে অ্যালানের পুলিশ অফিসারটি বলছিলেন, “এ এমন এক অনাকাঙ্খিত হত্যাকাণ্ড, ভাষা নেই আমার কিছু বলার”। তাকে বেদনাপ্লুত দেখাচ্ছিল। একটা পরিবার এভাবে পৃথিবী থেকে চলে যাওয়া নিঃন্দেহে কোনো সুস্থ সুন্দর মনের মানুষের কাছে বেদনাদায়ক।
সিটি ব্যাংক কর্মকর্তা তৌহিদ আলম (৫৪) স্ত্রী, তিন সন্তান ও শাশুড়িসহ পাইন প্লাফ ড্রাইভের বাসাতে (উপরে ছবি) থাকতেন। এই বাসার ভিতরে মোট ১০ বুলেটে ৬টি তাজা প্রাণ ঝরে গেছে। এ বাসা থেকে একই পরিবারের ৬ বাংলাদেশির লাশ উদ্ধার করেছিল পুলিশ সোমবার (৫ এপ্রিল) সকালে। নিহতদের মধ্যে দুজন টিনেজ ভাই, তাদের এক বোন, তাদের বাবা-মা এবং দাদি রয়েছেন। নিহতরা হলেন- আলতাফুননেসা (৭৭), আইরিন ইসলাম (৫৬), তৌহিদুল ইসলাম (৫৪), তানভীর তৌহিদ (২১), ফারবিন তৌহিদ (১৯) ও ফারহান তৌহিদ (১৯)।
কখনো কোনো ঘটনার সাথে প্রাকৃতিক অন্য ঘটনা বিস্ময়কর সম্বন্ধ রচনা করে। প্রকৃতিও যেন নিরব ভাষায় কিছু বলতে চায়।
যুক্তরাষ্ট্র থেকে লাভলু আনসার বাংলাদেশ প্রতিদিন-এ লিখেছেন, ‘মা-বাবা-বোন আর নানীর পাশে কবর হলো না ঘাতক দুই পুত্রের। পরিকল্পনা অনুযায়ী পাশাপাশি চারটি কবর খোড়ার পর পঞ্চম এবং ষষ্ঠ কবর খোড়ার সময় পানিতে ভরে যায় এ দুটি। শত চেষ্টা করেও পানি সরানো সম্ভব হয়নি। এ অবস্থায় বেশ কিছু দূরে শুকনা কবরের জায়গা খুঁজে সেখানেই দাফন করা হয় তানভির তৌহিদ (১৯) এবং তার ছোট ভাই ফারহান তৌহিদ (১৯)কে।’
তাদের লাশ উদ্ধারের পর এ্যালান পুলিশের তদন্ত কর্মকর্তা জানতে পারেন যমজ দুই ভাইই তাদের মা বাবা নানি ও বোনকে হত্যা করে নিজেরা আত্মহত্যা করেছিল। ফারহান সেসব তথ্য ইন্সটাগ্রামের পোস্টে লিখে গিয়েছিল। সে বিষণ্নতায় ভূগছিল।
লাভলু আনসার আরও লিখেছেন, ‘পুরান ঢাকার সন্তান তৌহিদ ডিভি লটারিতে সপরিবারে যুক্তরাষ্ট্রে এসে কয়েক বছর নিউইয়র্কে কাটিয়ে ৮ বছর আগে স্থানান্তরিত হয়েছিলেন এল্যান সিটিতে। সর্বশেষ পেশায় ছিলেন সিটি ব্যাংকের কর্মকর্তা হিসেবে। দু’পুত্র পড়ছিলেন ইউনিভার্সিটি অব টেক্সাসে। একমাত্র কন্যাটি পড়ছিলেন ফুল স্কলারশিপে নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটিতে। আমেরিকান স্বপ্ন পূরণে ধির পায়ে এগুচ্ছিলেন তৌহিদ। কিন্তু মাঝপথে থামিয়ে দিল মানসিক বিকারগ্রস্ত দুই পুত্র। গোটা কমিউনিটিকে হতবাক করেছে এই হত্যা ও আত্মহত্যার পরিক্রমা। শোকে স্তব্ধ কমিউনিটির সাথে জানাজা এবং দাফনের সময় শতশত আমেরিকানও এসেছিলেন। এলেন ইসলামিক সেন্টারে ৬ জনের জানাজা শেষে কফিনবাহী গাড়িকে স্কর্ট করে গোরস্থান পর্যন্ত নিয়ে যায় এল্যান সিটির পুলিশ। কফিনের মিছিল অনুসরন করছিল দু’হাজার মানুষের হাজারখানেক গাড়ি। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছিল যে, পুরো একটি এলাকা ধীর লয়ে বিষন্ন চিত্তে অজানার গন্তব্যের দিকে এগুচ্ছে।
চার কবর খোড়ার পর পঞ্চম আর ষষ্ঠ অর্থাৎ ঘাতক দু’ভাইয়ের জন্যে নির্ধারিত কবর খোড়ার সময়েই পানিতে ভরে যাওয়ায় অনেকে নানান মন্তব্য করছিলেন। সে সময় এলেন মসজিদের ইমাম আব্দুর রহমান বশির পবিত্র কোরআন-হাদিসের আলোকে সকলকে নিবৃত্ত করেন যে, বান্দার মৃত্যু হবার পর সকল দায়িত্ব সৃষ্টিকর্তার। আমাদের কর্তব্য হলো তাদের জন্যে দোয়া করা। এছাড়া, কেউই নিশ্চিত নই যে, তারাই হত্যার পর আত্মহত্যা করেছে। তদন্ত এখনও শেষ হয়নি। তাই ধৈর্যধারণ করতে হবে এবং মরহুম সকলের জন্যেই দোয়া করতে হবে।’
বিবিসি জানিয়েছে, ‘বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অফ নর্থ টেক্সাস এর সেক্রেটারি নাহিদা আলী বিবিসিকে বলছেন, ‘আকস্মিক এ ঘটনায় টেক্সাসের পুরো বাংলাদেশি সম্প্রদায় হতবাক হয়ে পড়েছে। পরিবারটি ছিলো ছিমছাম ও শান্তিপ্রিয়। প্রতিবেশীসহ অন্যদের সহযোগিতার জন্য সুনাম ছিলো তাদের। তিনটি বাচ্চাই খুব মেধাবী ছিলো। ছোট ছেলেটি ফেসবুকে একটি নোট দিয়ে গেছে। সেখানে সে বলেছে সে ও তার ভাই বিষণ্ণতায় ভুগছিলো দীর্ঘদিন ধরে। বিষণ্ণতার জন্য তারা দীর্ঘদিন ধরে চিকিৎসা নিচ্ছিল বলে ছোট ছেলেটি তার নোটে লিখেছে, যদিও পরিবার থেকে এসব কিছু কখনো অন্যদের সাথে শেয়ার করেনি।”
নিউইয়র্ক থেকে সাংবাদিক লাভলু আনসার আরও লিখেছেন, ‘৭ এপ্রিল সন্ধ্যায় এই পরিবারের সকলের আত্মার শান্তি কামনায় মোমবাতি প্রজ্বলনের কর্মসূচিতেও শতশত আমেরিকান এসেছিলেন। সকলেই গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। এল্যান সিটির সেলিব্রেশন পার্কে নিহতদের স্মরণে এই ‘মোমবাতি প্রজ্জ্বলন কর্মসূচি’তে সিটি মেয়র ক্যান ফাক-সহ বহু শোকার্ত মানুষের সমাগম ঘটে।’
উল্লেখ্য, অতীতে ক্যালিফোর্নিয়ার সানফ্রান্সিসকোতে হাসিব বিন রাব্বি তার মা-বাবাকে নৃশংসভাবে হত্যা করেছিল। তাছাড়া কানাডার টরেন্টোতে মিনহাজ জামান তার মা-বাবা-বোন-নানীকে হত্যা করেছিল। এ দু’জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়েছিল।