বিশাল ক্ষতি সত্বেও চীন মিয়ানমারে সেনা শাসনের পক্ষে কেন?
অনুপম নিউজ টোয়েন্টিফোর ডট কম প্রকাশিত হয়েছে : ০৬ এপ্রিল ২০২১, ১২:০২:১৩ অপরাহ্ন
সারওয়ার চৌধুরী: মিয়ানমারের সেনা শাসনের বিরোধিতাকারী জনগণ চীনবিরোধী শ্লোগান দিচ্ছে। চীনের ফ্যাক্টরিতে আগুন দেয়া হয়েছে। জান্তা সরকার গুলি চালাচ্ছে ‘গণতন্ত্রকামীদের’ উপর। মারা যাচ্ছে প্রতিবাদকারীরা। অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতিতে মারা গেছে ইতিমধ্যে নারী ও শিশুসহ পাঁচ শতাধিক মানুষ। ভারত সীমান্তে শরনার্থীদের ভিড়। তিন পুলিশ অফিসার পালিয়ে ভারতে গিয়েছেন। বাঁচতে চায় মিয়ানমারের সাধারণ মানুষ। শক্তিধর দেশগুলোর রাজনৈতিক দ্বন্দের চাপে তারা দিশেহারা কোভিড—১৯ মহামারির এ সময়ে।
এটা ঠিক জেনারেলদের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থানে নেই চীন। কারণ কি? সহজ উত্তর: চীনের অর্থনৈতিক স্বার্থে বড় ধরনের আঘাত আসবে। তাই বেইজিংয়ের তরফ থেকে মিয়ানমারের মিলিটারি ক্যু তাদের অপছন্দ তা বলে নি। জাতিসংঘে সেনাদের পক্ষ নিয়েছে চীন। কিন্তু অঙ সান সু চি-র সাথে চীনের ‘ভাল সম্পর্ক’ ছিল বলেই মিয়ানমারের সাথে স্বার্থ সংশ্লিষ্ট কূটনীতি বরাবর চলে আসছিল। সেনা অভ্যুত্থানের কারণে চীনের বিস্তর ক্ষতি হওয়া সত্বেও চীন অভ্যুত্থানের পক্ষ নেয়ার কারণ আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও ভূরাজনীতিতে কৌশলগত অবস্থান নেয়া। কুয়ালালামপুরে মালয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব চায়নার অধ্যাপক ড. সৈয়দ মাহমুদ আলী বলেন, কৌশলগত অর্থনীতির স্বার্থে যে দুটো দেশ চীনের কাছে এখন খুবই গুরুত্বপূর্ণ তার একটি হলো পাকিস্তান, অন্যটি মিয়ানমার।
চীনের কাছে মিয়ানমার খুব গুরুত্বপূর্ণ এ কারণে যে, বহু বছর ধরেই পশ্চিমের দেশগুলো এবং কিছু চীন বিরোধী অন্য প্রান্তের দেশ মনে করে মিয়ানমার হলো অপরিহার্য স্থান যার মাধ্যমে চীনকে কব্জায় রাখা সম্ভব।
সম্প্রতি ‘গ্লোবাল টাইমস’কে চীনের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক লি হেইডং জানিয়েছেন, ‘তাদের লক্ষ্য চীনকে নিয়ন্ত্রণ করা এবং এই অঞ্চলে চীনের প্রভাবকে হ্রাস করা’।
উল্লেখ্য, প্রতিবেশী বড় শক্তি হওয়ার কারণেই মিয়ানমারের সবচেয়ে বড় ব্যবসায়িক অংশীদার চীন। মিয়ানমারের সাথে চীনের দীর্ঘ ২,২০০ কিমি সীমান্ত রয়েছে। কিছু সীমান্ত এলাকায় বিদ্রোহী গোষ্ঠী রয়েছে।
বিশেষত, উচ্চাভিলাষী বেল্ট অ্যান্ড রোড প্রকল্পের জন্য চীনের কাছে মিয়ানমার খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিগত বছরগুলোতে মায়ানমারের বিভিন্ন অবকাঠামো প্রকল্পে প্রচুর বিনিয়োগ করেছে চীন। চীনের ইউনান প্রদেশ থেকে মিয়ানমারের পশ্চিম উপকূল পর্যন্ত রেল লাইন নির্মাণের প্রকল্পে চীন প্রায় ৯০০ কোটি ডলার বিনিয়োগ করবে।
চীনের তরফে কূটনৈতিক কৌশল এই যে, ফেব্রুয়ারির ১ তারিখ জেনারেলরা ক্ষমতা নেয়ার আগের মাসে, অর্থাৎ জানুয়ারির মাঝামাঝি চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই মিয়ানমার সফরে এসেছিলেন। তখন তিনি অঙ সান সু চিসহ মিয়ানমারের সেনা নেতৃত্বের সাথেও বৈঠক করেন। এতে কি এটা বোঝা যায় না যে, মিয়ানমারে সেনা ক্যু যে হতে যাচ্ছে তা চীন জানতো? সেনারা ক্ষমতা নেয়ার কয়েক সপ্তাহ আগে থেকেই মিয়ানমারের স্বাধীনতার নায়ক খ্যাত জেনারেল অঙ সানের মেয়ে সু চি-র সাথে গত বছরের নির্বাচনে কারচুপি নিয়ে অসন্তোষ চলছিল। সেনাবাহিনী বলেছে তাদের কাছে বিস্তর প্রমাণ আছে নির্বাচনে কারচুপির।
প্রশ্ন হচ্ছে, সু চি-র সাথে বেইজিং প্রধানের ‘সুন্দর সম্পর্ক’ থাকা সত্বেও ময়ানমারে সেনা অভ্যুত্থানের পক্ষে কেন চীন? জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের পাঁচ ভেটো পাওয়ারের একটি চীন তাই মিয়ানমারে সেনা অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে ২ ফেব্রুয়ারি যৌথ বিবৃতি দিতে অস্বীকৃতি জানায়। অর্থাৎ নিরাপত্তা পরিষদের তরফ থেকে সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত নেয়ার পথে বাধা দিল চীন। চীন তো জানেই মিয়ানমারের সংবিধানে যথেষ্ট ক্ষমতা দেয়া আছে সেনাবাহিনীকে।
যদিও ইতিমধ্যে বৈধ সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার প্রতিবাদে রাস্তায় নামা জনসাধারণের ওপর চড়াও না হতে জান্তা সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে যৌথ বিবৃতি দিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য। পশ্চিমের শক্তিধরেরা তাদের মতলবেই ‘গণতন্ত্রকামীদের’ পক্ষে। আমেরিকা গত ১১ ফেব্রুয়ারি সুনির্দিষ্ট নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে মিয়ানমারের সামরিক শাসকদের ওপর। ইউএস ট্রেজারি বিভাগ থেকে প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছিল, “বার্মার সামরিক বাহিনী যদি না পাল্টায় তাদের কর্মপন্থা, তাহলে আমরা অতিরিক্ত পদক্ষেপ নিতেও প্রস্তুত। যদি শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদকারীদের বিরুদ্ধে আরও সহিংসতা হয় তবে বার্মিজ সামরিক বাহিনী দেখতে পাবে যে আজকের নিষেধাজ্ঞাগুলো কেবল প্রাথমিক পদক্ষেপ।”
মিয়ানমারের জেনারেলরা পশ্চিমের ক্ষমতাধরদের বিবৃতিকে পাত্তা দিচ্ছে না। তারা তাদের কাজ করে যাচ্ছে ঠিক কিন্তু যদি আমেরিকার ইঙ্গিত মোতাবেক তারা ‘পাল্টায় তাদের কর্মপন্থা’, মানে আমেরিকার স্বার্থ সংরক্ষণে সম্মত হয়, তাহলে হিসাব অন্যরকম হবে।
সেনা অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখলে নেয়া মিয়ানমারের জান্তা সরকার দেশটির ২৩ হাজারেরও বেশি কারাবন্দিকে মুক্তি দিয়েছে।
সেনাবাহিনী মিয়ানমারে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে আগামী এক বছর ক্ষমতায় থাকার ঘোষণাও দিয়ে ফেলেছে। মিন্ট সুয়ে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর সাবেক জেনারেল। তিনি ইয়াঙ্গুন সেনা কমান্ড পরিচালনা করেছেন। তিনি এখন মিয়ানমারের ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট। মিয়ানমারের সেনাবাহিনী পরিচালিত মিয়াওয়ারদি টিভিতে মিন্ট সুয়ে স্বাক্ষরিত এক বিবৃতি পাঠ করা হয় ১ ফেব্রুয়ারি। তাতে মিন্ট সুয়ে বলেছেন, মিয়ানমারের আইনব্যবস্থা, প্রশাসন ও বিচারব্যবস্থা মিন অং হালিংয়ের কাছে হস্তান্তর করা হলো। আবার সেনাশাসন ফিরে এল। প্রসঙ্গত প্রশ্ন আসে এমন ঘটনা কি এবারই প্রথম হলো? উত্তর, না।
১৯৪৮ সালে ব্রিটেনের ঔপনিবেশিক শাসন থেকে স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই বেশির ভাগ সময় সেনাশাসন চলেছে মিয়ানমারে। ১৯৬২ সালে বেসামরিক প্রশাসন বাতিল করেছিলেন জেনারেল নি উইন।
পরে ২৬ বছর সরকার চালান নি উইন। ১৯৮৮ সালে অর্থনৈতিক দুরবস্থা ও কর্তৃত্ববাদী শাসনের প্রতিবাদে ব্যাপক বিক্ষোভের মুখে পদত্যাগ করেছিলেন তিনি। এর কয়েক সপ্তাহ পর দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি পুনরুদ্ধারের কথা বলে সামরিক নেতাদের নতুন একটি দল পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নেয়।
২০১১ সালে সামরিক জান্তা সরকারের নেতা জেনারেল থান সুয়ে পদত্যাগ করেন। দেশের সংবিধান মেনে অবসরপ্রাপ্ত জেনারেলদের সমন্বয়ে গঠিত সরকারের কাছে তিনি ক্ষমতা হস্তান্তর করেন।
অনেক আন্তর্জাতিক ভাষ্যকার মিয়ানমারের বর্তমান রাজনৈতিক সঙ্কটকে চীনের সাথে মার্কিন প্রভাব পরীক্ষার একটি দুর্দান্ত শক্তি প্রতিযোগিতা হিসাবে দেখছেন।
উল্লেখ্য, ইতিমধ্যে মিয়ানমারের সামরিক শাসক ১ ফেব্রুয়ারি ক্ষমতা দখল করার পর নিউ ইয়র্কের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাঙ্কে থাকা ১ বিলিয়ন ডলার সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছিল, বাইডেন প্রশাসন তা ব্লক করে দিয়েছে।
ওদিকে, মিয়ানমারের ১ ফেব্রুয়ারির ক্যু নিয়ে ভারতের ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া নেই। জেনারেল মিন অং হ্লাইংয়ের সাথে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ‘সম্পর্ক’ ভাল। রাজনীতির পর্যবেক্ষকরা বলেছেন, ভারত ভাল সুযোগ পাবে সামরিক জান্তার কাছ থেকে। ভারত জানে, ১৯৪৮ সালে স্বাধীন হওয়ার পর মাত্র ১৫ বছর বেসামরিক সরকারের হাতে মিয়ানমার শাসিত। বাকি ৫৭ বছর মিলিটারি শাসন করেছে। মিলিটারির কাছ থেকেই ভারত বেশি সুবিধা পেয়েছে অতীতে। তাই ভারতের পরিমিত প্রতিক্রিয়া: ‘আমরা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছি’।
সূত্র: গ্লোবাল টাইমস, ওয়াশিংটন পোস্ট, দ্য আটলান্টিক, কনভারসেশন, পলিটিকো, দ্য ডিপ্লোম্যাট, দ্য চায়না টাইমস, মায়ানমার টাইমস, সিবিএসনিউজ, দ্য গার্ডিয়ান, সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট।
সারওয়ার চৌধুরী : কবি, কলামিস্ট, অনুুুুুবাদক