আবহমান বাংলার আধুনিক কবি জসীম উদ্দীন: মুহিব উদ্দিন চৌধুরী
অনুপম নিউজ টোয়েন্টিফোর ডট কম প্রকাশিত হয়েছে : ১৯ মার্চ ২০২১, ২:০৬:৫১ অপরাহ্ন
আবহমান বাংলার আধুনিক কবি জসীম উদ্দীন: মুহিব উদ্দিন চৌধুরী
আবহমান বাংলার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে লালিত আধুনিক কবি ছিলেন পল্লীকবি জসীম উদ্দীন। যিনি একাধারে একজন খাঁটি বাঙালি কবি, গীতিকার, ঔপন্যাসিক, নাট্যকার ও লেখক।
তার রচিত বিখ্যাত নকশী কাঁথার মাঠ ও সোজন বাদিয়ার ঘাট বাংলা ভাষার গীতিময় কবিতার উৎকৃষ্টতম নিদর্শনগুলোর অন্যতম। তার রচিত নকশী কাঁথার মাঠ কাব্যগ্রন্থকে তার শ্রেষ্ঠ শিল্পকর্ম হিসেবে বিবেচনা করা হয় এবং পৃথিবীর অনেক ভাষায় এটি অনূদিত হয়েছে। তার লেখনীর মাধমে গ্রাম্য বাংলার অপরূপ সৌন্দর্য, জীবন এবং পরিবেশ-প্রকৃতি ফুটিয়ে তোলার জন্যি সুখ্যাতি ছিল বিশ্বব্যাপী এবং সেই সুখ্যাতির কারণেই পেয়েছিলেন ‘পল্লী কবি’ উপাধি।
পল্লী কবি জসীম উদদীনের ৪৫ তম মৃত্যুবার্ষিকী ছিল গত ১৪ মার্চ।
১৯০৩ সালের ১ জানুয়ারি ফরিদপুর শহরতলীর কৈজুরী ইউনিয়নের তাম্বুলখানা গ্রামে নানা বাড়িতে জন্ম নেন পল্লীকবি জসীম উদদীন। পুরো নাম জসীম উদ্দীন মোল্লা হলেও তিনি জসীম উদ্ দীন নামেই পরিচিত।
কবির পিতার নাম আনছার উদ্দীন মোল্লা (মৃত্যুর তারিখঃ ২৬-১১-১৯৪৩), মা আমেনা খাতুন মৃত্যুবরণ করেন ১৯৭৬ সালের ১৪ মার্চ। কবির পত্নী- বেগম মমতাজ জসীম উদ্দিন (মৃত্যুর তারিখঃ ১৪-০১-২০০৬), বড় ছেলে- কামাল আনোয়ার (হাসু) (মৃত্যুর তারিখঃ ০৩-৬-১৯৯০)।
কবির শিক্ষাজীবন শুরু হয় ফরিদপুর শহরের হিতৈষী স্কুলে। সেখানে প্রাথমিক শেষ করে তিনি ফরিদপুর জেলা স্কুল থেকে ১৯২১ সালে এসএসসি, ১৯২৪ সালে ফরিদপুর রাজেন্দ্র কলেজ থেকে এইচএসসি এবং একই কলেজ থেকে বিএ পাস করেন। তিনি ১৯৩১ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে থেকে এমএ পাস করেন। পরবর্তীতে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন। ১৯৬১ সালে চাকরি থেকে অবসর নেন তিনি।
-কিশোর বয়স থেকেই জসীম উদ্দীন কাব্য চর্চা-লেখালেখি শুরু করেন। কলেজে অধ্যয়নরত থাকা অবস্থায়, পরিবার এবং বিয়োগান্ত দৃশ্যে, একদম সহজ ও সাবলীল ভাষায় তিনি বিশেষ আলোচিত কবিতা ‘কবর’ লিখেন। তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাবস্থায় এই কবিতাটি প্রবেশিকার বাংলা পাঠ্যবইয়ে স্থান পায়।
“কবর
– জসীম উদ্দীন
ওইখানে তোর দাদীর কবর ডালিম গাছের তলে,
তিরিশ বছর ভিজায়ে রেখেছি দুই নয়নের জলে।
এতটুকু তারে ঘরে এনেছিনু সোনার মতন মুখ,
পুতুলের বিয়ে ভেঙে গেল বলে কেঁদে ভাসাইত বুক।
এখানে ওখানে ঘুরিয়া ফিরিতে ভেবে হইতাম সারা,
সারা বাড়ি ভরি এত সোনা মোর ছড়াইয়া দিল কারা।
সোনালী ঊষায় সোনামুখে তার আমার নয়ন ভরি,
লাঙ্গল লইয়া ক্ষেতে ছুটিতাম গাঁয়ের ও-পথ ধরি।
যাইবার কালে ফিরে ফিরে তারে দেখে লইতাম কত,
এ কথা লইয়া ভাবি-সাব মোর তামাশা করিত শত।”
তিঁনি গাছের পাশে, নদীর পাড়ে মাটিতে বসে মাটির সাথে মিশে গিয়ে কবিতা, গল্প লিখতেন। গ্রাম-বাংলার অপরূপ সৌন্দর্য অনুধাবন করে রচনা করেছেন অসংক্য় কবিতা ও গ্রন্থাবলী। ফলে তার প্রতিটি লেখায় ফুটে উঠেছে বাংলার ইতিহাস ও ঐতিহ্য। তার নকশী কাঁথার মাঠ (১৯২৯) ও সোজন বাদিয়ার ঘাট (১৯৩৪) বাংলা ভাষার গীতিময় কবিতার উৎকৃষ্টতম নিদর্শনগুলোর অন্যতম।
“নকশী কাঁথার মাঠ
– জসীম উদ্দীন
সখী দীন দুঃখীর যারে ছাড়া কেহ নাই
সেই আল্লার হাতে আজি আমি তোমারে সঁপিয়া যাই।
মাকড়ের আঁশে হস্তী যে বাঁধে, পাথর ভাসায় জলে
তোমারে আজিকে সঁপিয়া গেলাম তাঁহার চরণতলে।”
জসীম উদ্দীনের “নকশী কাঁথার মাঠ” কাব্যটি “দি ফিল্ড অব এমব্রয়ডার্ড কুইল্ট” এবং বাঙালীর হাসির গল্প গ্রন্থটি ফোক টেল্স অব ইষ্ট পাকিস্তান নামে ইংরেজিতে অনূদিত হয়েছে।
তার লেখা অসংখ্য পল্লিগীতি এখোনো গ্রাম বাংলার মানুষের মুখে মুখে শোনা যায়।যেমন- আমার হার কালা করলাম রে, আমায় ভাসাইলি রে, কাজল ভ্রমরা রে ইত্যাদি।
কবি জসীম উদ্দীনের বিখ্যাত কিছু গানের শিরোনাম-
– কাজল ভ্রমরা যে
– আমার সোনার ময়না পাখি
– আমার গলার হার খুলে নে
– আমার হার কালা করলাম রে
পল্লীকবি জসীম উদ্দীন ১৪ মার্চ ১৯৭৬ সালে ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। তার শেষ ইচ্ছা অনুসারে তাকে ফরিদপুর জেলার আম্বিকাপুর গ্রামে তার দাদীর কবরের পাশে দাফন করা হয়। তার নামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি আবাসিক হলের নামকরণ করা হয়েছে।
জসীম উদ্দীন ১৯৭৬ সালে ইউনেস্কো পুরস্কার, ১৯৬৮ সালে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের ডি.লিট উপাধি, ১৯৭৬ সালে ২১শে ও ১৯৭৮ এ (মরণোত্তর) স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার পদকে ভূষিত হন।
আবহমান বাংলার সংস্কৃতির কবি পল্লীকবি জসীম উদ্দীন’র মৃত্যুবার্ষিকীতে জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা ও সম্মান ৷
লেখক: মুহিব উদ্দিন চৌধুরী
সাংবাদিক, সমাজকর্মী .
সম্পাদক,অনুপম নিউজ টোয়েন্টিফোর