একুশ আমাদের চেতনা ও অস্তিত্বের প্রতিক, একুশ আমাদের আত্ম পরিচয়ের সোপান: মুহিব উদ্দিন চৌধুরী
অনুপম নিউজ টোয়েন্টিফোর ডট কম প্রকাশিত হয়েছে : ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ১:০৪:৩৫ অপরাহ্ন
একুশ আমাদের চেতনা ও অস্তিত্বের প্রতিক, একুশ আমাদের আত্ম পরিচয়ের সোপান।
একুশ আমাদের চেতনা ও অস্তিত্বের প্রতিক, একুশ আমাদের আত্ম পরিচয়ের সোপান। দীর্ঘ ৬৯ বছরের পথ পরিক্রমায় আমাদের মাঝে আবার এলো ২১শে ফেব্রুয়ারী। এটি শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসাবেও সুপরিচিত। একুশে ফেব্রুয়ারি দিনটি বাংলাদেশ সহ পশ্চিমবঙ্গ তথা সমস্ত বাংলা ভাষা ব্যবহারকারী বাঙালি জনগণের ভাষা আন্দোলনের মর্মন্তুদ ও গৌরবোজ্জ্বল স্মৃতিবিজড়িত একটি দিন হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে।
আজ থেকে ঊনসত্তর বছর পূর্বে ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি জাতির বিবেক ছাত্র সমাজ জাতি সত্তার ডাক দিয়ে আত্মত্যাগের বিনিময়ে সৃষ্টি করেছিল এক অবিস্মরণীয় ইতিহাস।
পাকিস্তানি স্বৈরশাসক বাঙালি জাতিসত্তা বিলীন করে দেওয়ার মানসে ১৯৫২ সালের এই দিনে (৮ ফাল্গুন, ১৩৫৮, বৃহস্পতিবার) আমাদের মাতৃভাষা বাংলার পরিবর্তে উর্দু ভাষা প্রতিষ্টার জন্য নির্দেশ জারি করে, আর তখনই এই অযৌক্তিক দাবির প্রতিবাদে বিস্ফোরিত হয় বাঙালী জাতি, জ্বলে উঠলো শিক্ষাঙ্গন সহ সারা দেশে প্রতিবাদের স্ফুলিঙ্গ।
বাংলার ছাত্র-জনতা ঐদিন মাতৃভাষা প্রতিষ্ঠার জন্য বিক্ষুভে ফেটে পড়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা ১৪৪ ধারা অমান্য করে রাজপথে বেরিয়ে এলে আন্দোলনের তীব্রতা বাড়তে থাকায় পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী ভিত নড়ে ওঠে। পুলিশ ও সেনাবাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়ে বাঙালি ছাত্র জনতার উপর, গুলি চালায় নির্বিকারে। বাংলাকে পূর্ব পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে আন্দোলনরত ছাত্রদের ওপর পুলিশের গুলিবর্ষণে কয়েকজন তরুণ শহীদ হন। তাদের মধ্যে অন্যতম হলো রফিক, জব্বার, শফিউল, সালাম, বরকত সহ সহ আরো অনেক নাম-না-জানা বাঙালি ছাত্র-জনতা।
এ ঘটনার প্রতিবাদে ঢাকার ক্ষুব্ধ ছাত্র জনতা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হোস্টেলে সমবেত হয়। নানা নির্যাতন সত্ত্বেও ছাত্রদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষেরা প্রতিবাদ জানাতে পরের দিন ২২ ফেব্রুয়ারি পুনরায় রাজপথে নেমে আসে। তারা মেডিকেল কলেজ হোস্টেল প্রাঙ্গণে শহীদদের জন্য অনুষ্ঠিত গায়েবি জানাজায় অংশগ্রহণ করে। ভাষা শহীদদের স্মৃতিকে অমর করে রাখার জন্য ২৩ ফেব্রুয়ারি এক রাতের মধ্যে মেডিকেল কলেজ হোস্টেল প্রাঙ্গণে গড়ে ওঠে একটি স্মৃতিস্তম্ভ, যা পাক সৈরশাসক ২৬ ফেব্রুয়ারি গুঁড়িয়ে দেয়। একুশে ফেব্রুয়ারির এই ঘটনার মধ্য দিয়ে ভাষা আন্দোলন আরও বেগবান হয়।
১৯৫৪ সালে প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট জয়লাভ করলে ৭ মে অনুষ্ঠিত গণপরিষদের অধিবেশনে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। বাংলাকে পাকিস্তানের দ্বিতীয় রাষ্ট্রভাষা হিসাবে স্বীকৃতি দিয়ে সংবিধানে পরিবর্তন আনা হয় ১৯৫৬ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি।
১৯৮৭ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি জাতীয় সংসদে ‘বাংলা ভাষা প্রচলন বিল’ পাশ হয়। যা কার্যকর হয় ৮ মার্চ ১৯৮৭ সাল থেকে।
১৯৯৯ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ নভেম্বর অনুষ্ঠিত ইউনেস্কোর প্যারিস অধিবেশনে একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস করার প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়। প্রস্তাবে ১৮৮টি দেশ সমর্থন জানালে একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয় এবং ২০০০ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি থেকে দিবসটি জাতিসঙ্ঘের সদস্যদেশসমূহে যথাযথ মর্যাদায় পালিত হচ্ছে।
বায়ান্নর একুশে আমাদের দিক নির্দেশনা দিয়েছে। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে বিজয়ের ফলশ্রুতিতেই চুয়ান্নর গণরায়, বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, একাত্তরের সশস্র মুক্তিসংগ্রাম এবং অবশেষে একান্বইয়ের স্বৈরশাসনের অবসান অনিবার্য হয়ে উঠেছিল। ভাষা আন্দোলনের সফলতা আমাদের আত্মমর্যাদাবোধ এবং স্বাধীকার চেতনার বীরোচিত প্রকাশ ঘটেছিলো বিশ্ববাসীর কাছে।
প্রতি বছর আমরা একুশে ফেব্রুয়ারি পালন করি গণতান্ত্রিক গতানুগতিক ধারায়। একুশে ফেব্রুয়ারি মাস এলেই আমাদের ভাষা শহীদদের মমত্ববোধ বেড়ে যায় কিন্তু এই গতানুগতিক ধারার এ দিবসটি পালন করে চলবে না, কারণ বায়ান্ন ও একাত্তরের পরাজিত শক্তি এখনও আমাদের মাঝে বিচরণ করছে, সংগঠিত হচ্ছে বাঙালি জাতিসত্তার বিলীনের প্রচেষ্টায়। আজ ৬৯তম শহীদ দিবসে আমাদের শপথ নিতে হবে বাস্তবমুখী কর্মসূচি নিয়ে এদের প্রতিহত করার।
মুহিব উদ্দিন চৌধুরী
সম্পাদক, অনুপম নিউজ টুয়েন্টিফোর