ইসহাক কাজল : তোমার তুলনা তুমি
অনুপম নিউজ টোয়েন্টিফোর ডট কম প্রকাশিত হয়েছে : ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ৯:২৬:২৪ অপরাহ্ন
ইসহাক কাজল : তোমার তুলনা তুমি
– আনোয়ার শাহজাহান
ইসহাক কাজল, একাধারে মুক্তিযোদ্ধা, সাংবাদিক ও সংগঠক। বাংলা একাডেমির পুরস্কার প্রাপ্ত লেখক। এই গুণী ব্যক্তির নামের সঙ্গে আমার পরিচয় দুই দশকের বেশি সময় আগে থেকে হলেও ব্যক্তিগত পরিচয় খুব একটা বেশি দিনের নয়। সময়টা ২০১৩ সালের শেষের দিকে। পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন আমাদের আরেক গুণীজন, ‘বাংলা একাডেমি প্রবাসী পুরস্কারপ্রাপ্ত’ লেখক-গবেষক ফারুক আহমদ। সেদিন আমরা ব্রিকলেইনের একটি রেস্টুরেন্টে বসে প্রায় ঘন্টাখানেক চুটিয়ে আড্ডা দিলাম, চায়ের কাপে ঝড় তুলে রাজা-উজিরও মারলাম। সামান্য সময়ের আলাপ-পরিচয়, অথচ মনে হল তিনি যেন আমার অনেক দিনের চেনাজানা, আত্মার আত্মীয়। আমিও মাঝেমধ্যে লেখালেখি করি এ কথা শুনে আমাকে উৎসাহ দিয়ে বললেন, আগামী সংখ্যা জনমতের জন্য একটি লেখা দেবেন। যে কোনো বিষয় নিয়ে লেখতে পারেন। যেমন কবিতা, গল্প, ছড়া, কলাম, আঞ্চলিক ইতিহাস যে বিষয়ে আপনি ভালো মনে করবেন। বললাম আমার কম্পিউটারে বাংলা ফ্রন্ট নেই, টাইপও করতে পারিনা। সহাস্যে বললেন, কোচ পরোয়া নেই, হাতে লিখেই পাঠিয়ে দেবেন। তবে বর্তমানে লেখালেখি করতে হলে টাইপ করতে জানা জরুরি। আপনার টাকা-পয়সা আছে ভালো একটি কম্পিউটার কিনে তাতে বাংলা ফ্রন্ট ইন্সটল করে টাইপ করা শিখে নিন। এটা কাজে আসবে। আমি নিজেও জানতাম না, এখানে এসে জনমত সম্পাদক নবাব উদ্দিনের কল্যানে শিখেছি। আমি বুড়ো মানুষ এই বয়সে শিখতে পারলে আপনার কাছে এটা ডালভাত। একবার লেগে গেলেই দেখবেন হয়ে গেছে।
মনে পড়ে গেল আমার প্রিয় পিতাজির কথা। তিনিও ঠিক এইভাবে আমাদের প্রেরণা দিতেন, লেগে থাকার কথা বলতেন। মাতাপিতার প্রেরণার কারণেই আমরা ভাইবোন প্রায় সকলেই আজ কমবেশি অন্তত আর্থিকভাবে প্রতিষ্ঠিত। এর আগে ফারুক ভাইও আমাকে, বিশেষ করে ব্যবসা-বাণিজ্যের পাশাপাশি লেখালেখি চালিয়ে যাবার কথা বলতেন। এই দুই জনের উৎসাহে আবারও গোলাপগঞ্জের ইতিহাস ও ঐতিহ্য বইয়ের প্রথম সংস্করণ করার ব্যাপারে উদ্যোগী হলাম। একইসঙ্গে ‘আমাদের গোলাপগঞ্জ’ নামে মাসিক একটি পত্রিকা প্রকাশনা ও সম্পাদনা করতে শুরু করলাম। কাগজটির প্রথম সংখ্যা প্রকাশ করি ২০১৪ সালের আগস্ট মাসে। ফারুক ভাই বললেন, লন্ডনে কাগজটির একটি প্রকাশনা করলে লোকের নজরে আসবে। আমি থাকি লন্ডন শহর থেকে একটু দূরে, কেন্টে। সেখান থেকে এসে প্রকাশনা উৎসব করা আমার পক্ষে বেশ কঠিন হবে এ কথা বলায় তিনি আমাকে বললেন, আপনাকে একাজে উৎসাহ দিয়েছেন ইসহাক ভাই। আপনি তাকে বলুন তিনিই কাজটি করে দেবেন। এব্যাপারে তার কোনো জুড়ি নেই। তারপর আমাকে বললেন আজই আপনি আসুন ব্রিকলেইনে, আমরা একসঙ্গে বসে সিদ্ধান্ত নেবো। আমি আসলাম। আবারও আমরা তিনজন চুটিয়ে আড্ডা দিলাম। ফারুক ভাইয়ের স্বভাব হল তিনি সোজা-সাপটা কথা বলেন। তাই সরাসরি ইসহাক ভাইকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘আপনি শাহজাহানকে লেখালেখিতে ফিরে আসার জন্য অনুপ্রাণিত করায় তিনি ফিরে এসেছেন। আপাতত একটি বাংলা কাগজ বের করেছেন। আমি মনেকরি এটার প্রকাশনা উৎসব হওয়া দরকার। কিন্তু দায়িত্বটা অনুপ্রেরণা দেয়ার দায়িত্ব হিসেবে আপনাকেই নিতে হবে।’
কথাটা শুনেমাত্র ইসহাক ভাইয়ের পাল্টা প্রশ্ন, ‘কোন মাসে, কোন সেন্টারে করতে চান বলুন। ব্রাডি আর্ট সেন্টারে করতে হলে সময়ের প্রয়োজন। সব সময় বুকিং পাওয়া যায় না। আর মন্টিফিওরি সেন্টারে করতে হলে আজই বুকিং দিয়ে দেব। এ ব্যাপারে চিন্তার কোনো কারণ নেই।’
তারপর আমার কাছে জানতে চাইলেন, ‘আনুমানিক কতজন লোক হবে’? আমি সংখ্যাটা বলার পর তিনি এ ব্যাপারে পুরো পরিকল্পনাটা আমার কাছে তুলে ধরলেন। যদি আপ্যায়নের ব্যবস্থা করতে চাই তা হলে এতো খরচ হবে। আমি দেখলাম এমন সুযোগ হাতছাড়া করা যায় না। তাই রাজী হয়ে গেলাম। তারপর অনুষ্ঠানের দিন বই নিয়ে আসা ছাড়া পুরো দায়িত্ব তিনিই পালন করেছেন। এমনকি পুরো অনুষ্ঠানটি তিনি নিজেই পরিচালনা করেন। কিন্তু তার দায়-দায়িত্বের এখানেই শেষ নয়। অনুষ্ঠানের খবর টেলিভিশনে পাঠানো, রিপোর্ট তৈরী করে সংবাদপত্রে দিয়ে তা প্রকাশ করা এবং এরও পরে যে যে সংবাদপত্রে খবর প্রকাশিত হয়েছিল যেসকল সংবাদপত্রগুলো সংগ্রহ করে আমার কাছে পাঠিয়ে তার মহত্বের পরিচয় দিয়েছেন। সেজন্য তাকে কৃতজ্ঞতা জানানোর কোনো ভাষা যেমন সেদিন খুঁজে পাই নি, আজও পাচ্ছি না।
অন্তত আমার এ ছোট্ট জীবনে এমন নিঃস্বার্থ সহযোগী আমি খুব কমই পেয়েছি। এভাবে তার সঙ্গে আমার সখ্য গড়ে উঠে তা আজও অটুট আছে। সেদিন ফারুক ভাইয়ের মাধ্যমেই খবর পেলাম তিনি অসুস্থ্য। তাকে দেখতে যাবার ইচ্ছে প্রকাশ করায় বললেন, তার কিমো চলছে, সব সময় ঘরে থাকেন না। আবারও খবর নিলাম শুনলাম তিনি হাসপাতালে। ফারুক বললেন মেয়েকে ফোন করেছিলেন তারা এখনো যোগাযোগ করে নি। এছাড়া ঘরে কোনো ফোন নেই। এভাবে যাবো-যাচ্ছি করে এখনো তাকে দেখতে যাওয়া হয় নি।
মনেপ্রাণে খাঁটি দেশপ্রেমিক বাঙালি ইসহাক কাজল শৈশব-কৈশোরেই মধ্যে প্রতিবাদী চেতনার জাগরণ ঘটে। ছাত্রজীবনেই তিনি রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হন। মাত্র তেইশ বছর বয়সে বঙ্গবন্ধুর ডাকে উদ্দীপ্ত হয়ে মুক্তিযুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়ে দেশ স্বাধীন করেছেন। কিন্তু এর পরেও নিশ্চুপ হয়ে ঘরে বসে থাকেন নি। দিনরাত কঠিন পরিশ্রম করে মুক্তিযোদ্ধাদের ইতিহাসকে তুলে ধরতে। তাদের জীবনকাহিনী নিয়ে গ্রন্থ প্রকাশে কাজ করেছেন, ‘মুক্তিযোদ্ধাদের জীনন সংগ্রাম’, সম্পাদনা করেছেন, ‘বীরাঙ্গণাদের জীবনকথা’। আজ দেখলাম ইত্যাদি গ্রন্থ প্রকাশ থেকে প্রকাশিত হচ্ছে তার আরেকটি গ্রন্থ ‘মুক্তিযোদ্ধারা : সংগ্রামে সংকটে’। এই নামগুলোই বলে দেয় তিনি কী বলতে চান, কোন মানুষগুলোর কথা বলতে চান। তার আরও অনেক অপ্রকাশিত গ্রন্থ রয়েছে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো জেনারেল এম এ জি ওসমানী নিয়ে লেখা। বইটির নাম জানা হয় নি, কিন্তু গল্প শুনেছি। তার অনেক কাজ এখনো বাকি। তার সেই অসমাপ্ত কাজগুলোর জন্য এই গুণী, পরিশ্রমী, মেহনতি মানুষের আপনজন আমাদের মধ্যে দেশ ও দশের প্রয়োজনে আরও অনেকদিন বেঁচেবর্তে থাকুন, সুস্থ থাকুন। আল্লাহ রাব্বুল আল আমিনের কাছে এই প্রার্থনা করি।
আনোয়ার শাহজাহানঃ
লেখক ও সাংবাদিক, সম্পাদক, আমাদের প্রতিদিন।